বাংলার মালালা

---

নরওয়ের রাজধানী অসলোতে তিন দিনব্যাপী শিশু ও নারীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেয় সাহিদা আক্তার স্বর্ণা। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী আর্না সোলবার্গ। সম্মেলনে বাংলাদেশের কন্যা স্বর্ণা তুলে ধরে তার জীবনের দুঃখগাথা। একই সঙ্গে তার মতো নিপীড়িত শিশুদের সচেতন করে সংগ্রামী করার গল্প শুনে স্বর্ণাকে বাংলার মালালা ইউসুফজাই বলে আখ্যা দেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী আর্না সোলবার্গ। সেখানে নিজের অভিজ্ঞতা ও কাজের ধরণ নিয়ে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মালালার সঙ্গেও ফোনে কথা হয় তার।

এতে ‘বিকজ আই অ্যাম গার্ল’ এবং অসলো ফ্রিডম ফোরাম কনফারেন্স’-এ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে বক্তৃতা করেন তিনি।

অভাবক্লিষ্ট সংসারে একটিমাত্র পুত্রের আশায় পর পর অনাকাক্সিক্ষত পাঁচ কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। পুত্রসন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পাঁচ কন্যাসন্তানের মাকে “অপয়া” আখ্যা দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন বাবা। কন্যাদের পড়ালেখার খরচ দিতে পারবেন না বলে বাবা বাল্যবিবাহ দেন বড় মেয়েকে। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কন্যাকেও বাল্যবিবাহ দিয়ে বাবা চতুর্থ শিশুকন্যারও বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করেন। কিন্তু বাদ সাধে চতুর্থ কন্যা সাহিদা আক্তার স্বর্ণা। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সে। এভাবে একবার নয়, দুই দফা নিজের বাল্যবিবাহ পণ্ড করে গ্রামে তুমুল আলোচিত হয়ে ওঠে স্বর্ণা।

শুধু নিজের নয়, গ্রামের যেখানেই বাল্যবিবাহ, সেখানেই হানা দিত সে। কখনো কন্যাশিশুর মা-বাবাকে বুঝিয়ে, কখনোবা শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের সহযোগিতায় পণ্ড করে দিত বাল্যবিবাহ। আশপাশের ১০ গ্রামের শিশুদের মধ্যে স্বর্ণা এখন অপার সম্ভাবনার প্রতীক। সাহিদা আক্তার স্বর্ণা গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের সিংদীঘি গ্রামের দরিদ্র তোতা মিয়ার কন্যা। নিজের অদম্য ইচ্ছার কাছে চরম দারিদ্র্যকেও হার মানিয়েছে স্বর্ণা। সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।

স্বর্ণার স্বপ্ন গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের অবহেলিত শিশু ও নারীদের পাশে দাঁড়ানোর। বর্তমানে প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল শিশু সুরক্ষা দলের সদস্য ও যুব নারী সংঘের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছে স্বর্ণা। ৭ অক্টোবর তিন দিনব্যাপী নরওয়ের রাজধানী অসলোতে অনুষ্ঠিত শিশু ও নারী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও স্বর্ণা অংশ নেয়। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী আর্না সোলবার্গ। ওই সম্মেলনে ১৩টি দেশের ৩২ জন শিশু ও নারী প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। সম্মেলনে স্বর্ণা তার জীবনের দুঃখগাথা তুলে ধরে।

স্বর্ণার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তার বাবা তোতা মিয়া স্রেফ সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। মা শরিফুন নেছা পড়ালেখা করেননি। বাবা সব সময় কামনা করেছেন পুত্রসন্তান। পুত্রসন্তানের আশায় এক এক জন্ম নেয় পাঁচ কন্যা। পুত্রসন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার মাকে অবর্ণনীয় নির্যাতন করতেন বাবা তোতা মিয়া। বোনদের সঙ্গেও করতেন চরম দুর্ব্যবহার। পড়ালেখার খরচ দিতে পারবেন না বলে তাদের শিশুবয়সেই বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তোতা মিয়া। প্রথমে বড় মেয়ে মোক্তারা আক্তারকে বাল্যবিবাহ দেন। এরপর মাত্র ১৪ বছর বয়সে ছোট মেয়ে ইসমত আরাকেও জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া হয়। জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়ায় ইসমত আরা স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে স্বাবলম্বী হন। দ্বিতীয় কন্যা রাশিদা আক্তারকেও বাল্যবিবাহ দেন তোতা মিয়া।

একপর্যায়ে গত ২০০৫ সালে তার মা শরিফুন নেছাকে “অপয়া” আখ্যা দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন তোতা মিয়া। তখন স্বর্ণা মাওনা ইউনিয়নের বারোতোপা আফসার উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। স্বর্ণা জানায়, নবম শ্রেণীর ছাত্রী থাকাকালে পাশের চকপাড়া গ্রামের এক নির্মাণশ্রমিকের সঙ্গে তাকে না জানিয়ে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করেন তার বাবা। সে জানতে পেরে প্রথমে তার অস্বীকৃতির কথা জানায়। তাতে কাজ না হলে সিংদীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি রেজাউল করিম রুবেল, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্যসহ গ্রামের শিক্ষকদের ঘটনা জানায়। তার বাবা সিদ্ধান্ত না বদলালে স্বর্ণা নানাবাড়ি গিয়ে বাবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আকুতি জানায়। এতে তার বাল্যবিবাহ পণ্ড হয়ে যায়।

এরপর তার পড়ালেখার খরচ দিতে না চাইলে সে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের পড়িয়ে তার পড়ালেখার খরচ জোগাতে থাকে। ২০১০ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাস করে স্বর্ণা। এরপর আবারও তাকে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগে তার বাবা। পোশাক কারখানার এক শ্রমিকের সঙ্গে তার বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক করা হয়। এবার বাবার সঙ্গে যোগ দেন তার বড় ভগ্নিপতি। স্বর্ণা রাজি না হওয়ায় তার বাবা তাকে মারধরও করেন। কিন্তু তার অমতে বিয়ে দিলে সে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়। এতে পিছু হটে বাবা ও ভগ্নিপতি।

স্বর্ণা জানায়, দুই দফা সে নিজের বিয়ে পণ্ড করায় গ্রামে নানা কথা রটে। কেউ বলেন, “মেয়ের অন্য কারও সঙ্গে গভীর প্রেম রয়েছে।” কেউবা বলেন, “এ কেমন জাতের মেয়ে!” এরই মধ্যে প্রতিবেশী এক কন্যাশিশুর বাল্যবিবাহের খবর জেনে স্বর্ণা ছুটে গিয়ে অভিভাবকদের বিয়ে বন্ধ করার আহ্বান জানায়। ব্যর্থ হওয়ার পর শ্রীপুর উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাকে ঘটনা জানায় স্বর্ণা। পরে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা বিলকিস নাহার পুলিশসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে বাল্যবিবাহ পণ্ড করে দেন।

স্বর্ণা জানায়, এভাবে গ্রামে একের পর এক বাল্যবিবাহ পণ্ড করে দেয় সে। পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সিংদীঘি গ্রামে শিশুদের নিয়ে গড়ে তোলে “সূর্যমুখী শিশু ক্লাব”। পাশাপাশি সে অন্তর্ভুক্ত হয় প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের শিশু সুরক্ষা প্রকল্পে। প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে ২০১২ সালে মাওনা ইউনিয়ন শিশু ফোরামের সভাপতি নির্বাচিত হয় স্বর্ণা।

সে জানায়, শিশুদের ছয়টি মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন বিষয়ে সচেতন করে তুলতে সে তার সংগঠনের শিশুদের নিয়ে ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়েছে। বাড়িয়েছে সচেতনতা। স্বর্ণার দুঃখগাথা শুনে অসলো সম্মেলনে যোগ দেওয়া সব শিশু ও নারী আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

সম্মেলনে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী আর্না সোলবার্গ বলেন, “স্বর্ণা হলো বাংলার মালালা ইউসুফজাই।” স্বর্ণা বলে, প্রত্যেক শিশুকেই মনে রাখতে হবে “আমার ভিতর রয়েছে অপার সম্ভাবনা”। স্বর্ণা জানায়, পারিবারিক বাধা উপেক্ষা করে সে এখন গাজীপুরের চান্দনা ভাওয়াল বদরে আলম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পাঁচটি টিউশনি করে সে তার নিজের পড়ালেখার খরচ জোগায়।

স্বর্ণার বাবা তোতা মিয়া দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়ি ঘরজামাই হিসেবে থাকেন। স্বর্ণা প্রসঙ্গে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি স্বর্ণার জন্য দোয়া করি। ও একদিন অনেক বড় অইব। অহন আমি আমার ভুল বুঝবার পারি।”

মাওনা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক জানান, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় ২০১৩ সালে সাহিদা আক্তার স্বর্ণা শ্রীপুর উপজেলার সেরা নারী নির্বাচিত হয়। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, “স্বর্ণা একদিন আমাদের সমাজ বদলে দেবে।” সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।


অগ্রযাত্রা বিভাগের আরো খবর...
গণফোরামে যোগ দিলেন আ’লীগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ গণফোরামে যোগ দিলেন আ’লীগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ
আ. লীগের মনোনয়ন পেলেন যেসব তারকা আ. লীগের মনোনয়ন পেলেন যেসব তারকা
শেখ হাসিনা : গণতন্ত্রের মানসকন্যা ও পরিবর্তনের অগ্রদূত শেখ হাসিনা : গণতন্ত্রের মানসকন্যা ও পরিবর্তনের অগ্রদূত
‘প্রধানমন্ত্রী সত্যিই আপনি অসাধারণ’ ‘প্রধানমন্ত্রী সত্যিই আপনি অসাধারণ’
জাতীয় পার্টির বাছাইয়ে এগিয়ে হিরো আলম জাতীয় পার্টির বাছাইয়ে এগিয়ে হিরো আলম
আশ্বাস পেলেও সহযোগিতা পাচ্ছেন না চামেলী! আশ্বাস পেলেও সহযোগিতা পাচ্ছেন না চামেলী!
আসছে ডাক বিভাগের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ‘নগদ’ আসছে ডাক বিভাগের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ‘নগদ’
১৫ই আগষ্ট যারা নিহত হয়েছিলেন ১৫ই আগষ্ট যারা নিহত হয়েছিলেন
পোশাক ‘বিতর্কে’ ক্ষমা চাইলেন মোশাররফ করিম পোশাক ‘বিতর্কে’ ক্ষমা চাইলেন মোশাররফ করিম
আবিদের পাশেই চিরশায়িত হবেন স্ত্রী আফসানা আবিদের পাশেই চিরশায়িত হবেন স্ত্রী আফসানা

বাংলার মালালা
(সংবাদটি ভালো লাগলে কিংবা গুরুত্ত্বপূর্ণ মনে হলে অন্যদের সাথে শেয়ার করুন।)
tweet