স্বাধীনতা পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

‘ধ্বংস নয়, আমরা শান্তি চাই’

আজ ২৫ মার্চ ২০১৫ সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্বাধীনতা পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছে, তাদেরই একসময় স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ বুধবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্বাধীনতা পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।এর আগে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সাত গুণীজনের হাতে স্বাধীনতা পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী ।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল তাদের, যারা হয়তো বাংলাদেশের স্বাধীনতাই চায়নি; বরং হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছে। অথচ তাদের পুরস্কার দিয়ে এই পুরস্কারকে কলঙ্কিত করা হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এই সময় এসেছিল। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসকে মুছে ফেলে মনগড়া ইতিহাস রচনা করা হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের নাম একরকম নিষিদ্ধ হয়েছিল। যেকোনো একটি জাতি যখন স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন তারা সেটা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে। অথচ ‘৭৫-এর পর একটি প্রজন্ম জানতেই পারেনি, এই অর্জনের পেছনে কত আত্মত্যাগ, বিজয় অর্জনের পেছনে কত হাহাকার।

সে সঙ্গে যারা মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, নির্যাতন, মানবতাবিরোধী কার্যক্রম করেছে, তাদের রক্ষার অপচেষ্টাও চলেছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশে এ ঘটনা দেখা না গেলেও এখানে তা ঘটেছে। গণতন্ত্রকে পদদলিত করে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করা হয়েছে। ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যারা প্রতিবাদ করেছে, তাদের ওপর নেমে এসেছে অত্যাচার।

নিজের বক্তব্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ২৪ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। ধাপে ধাপে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বিদেশি বন্ধু বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করেছেন, যাদের সহযোগিতায় বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছে, সেসব মিত্র দেশ, তাদের মানুষকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই পুরস্কার দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার। বিশিষ্ট ব্যক্তি যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখেন, তাঁদেরই এ পুরস্কার দেওয়া হয়। আমরাও চেষ্টা করেছি, ২০১৫ সালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা অবদান রেখেছেন, আমরা তাঁদের আজ পুরস্কৃত করলাম।’

শেখ হাসিনা বলেন, দীর্ঘ ত্যাগের ফসল এই স্বাধীনতা। ভাষা আন্দোলন থেকে এর যাত্রা শুরু। বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়নি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ভাষণের মধ্য দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পুরো মার্চে যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক তিনি দিয়েছিলেন, প্রত্যেক বাঙালি তা মেনে চলত। ৭ মার্চের পর থেকে পাকিস্তানি শাসন এক প্রকার অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। ইয়াহিয়া খানের নয়, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মানতেন প্রত্যেক বাঙালি। সেই অসহযোগ আন্দোলনই ধীরে ধীরে সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল।

২৫ মার্চ নিরস্ত্র সাধারণ বাঙালির ওপর গণহত্যার সময় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করে দেন শেখ মুজিব। ঘোষণার পরপরই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সব পরিকল্পনা তিনি আগেই করে রেখেছিলেন। তাই মাত্র নয় মাসে বিজয় অর্জন করে বাঙালি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র সাড়ে তিন বছরে সংবিধান উপহার দিয়েছেন। তাঁর আমলেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সদস্যপদ, স্বীকৃতি বাংলাদেশ অর্জন করেছিল।

যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন মাত্র সাড়ে তিন বছরে, তাও সীমিত সম্পদ নিয়ে। যখন তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই আসে ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট।

এর পর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগই ইতিহাসকে সবার সামনে তুলে ধরে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যারা সৃষ্টি করে, সৃষ্টির জন্য ত্যাগ করে, তারা কখনো সেটাকে ধ্বংস করতে পারে না। একটা সময় স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় বসানো হয়, বাঙালি জাতিকে পরনির্ভরশীল করে রাখা হয়, পরনির্ভরশীল হওয়ার মনোবৃত্তি নিয়েই ২১ বছর দেশ চলে।

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘দেশ আর জনগণের প্রতি আওয়ামী লীগের একটা দায়িত্ববোধ রয়েছে। আমরা মনে করি, স্বাধীনতা আমরা এনেছি; জাতিকে বিশ্বসভায় মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করাই আমাদের লক্ষ্য।’

মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বেশ একটা ঝড়ঝাপ্টা গেছে। ২০০৯-এ ক্ষমতায় আসার পর আবার ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। ফলে বিশ্বের কাছে এখন বাংলাদেশ উন্নয়নের মডেল। সারা বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক মন্দার সময় ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, চিকিৎসাসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘এক বছর ধরে উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাওয়ার পর, আবার জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হলো ধ্বংসের রাজনীতি। কার স্বার্থে? রাজনীতিতে কেউ যদি কোনো ভুল করে, তার খেসারত তো জনগণ দেবে না। কিন্তু এখানে মানুষের অগ্রযাত্রাকে বাধা দেওয়ার মতো অপকর্ম চলছে। আমরা ধৈর্য ধরে সব মোকাবিলা করছি। কেউ জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না। সাধারণ মানুষ যেখানে চলাফেরা করে, সেই বাস-ট্রেনে তাদের ওপর হামলা করা, মানুষের ওপর জুলুম-অত্যাচার, এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। ধ্বংস নয়, আমরা শান্তি চাই।’

শেখ হাসিনা যোগ করেন, দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে চলবে, এটাই আমরা চাই। কিছু মুষ্টিমেয় লোকের জন্য ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, এটা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। জঙ্গি তৎপরতার হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে সবার সহযোগিতা চান তিনি।

সবাই মিলে কাজ করে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ‘৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করা সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

আজ ২৫ মার্চ ২০১৫ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।এর আগে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সাত গুণীজনের হাতে স্বাধীনতা পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পুরস্কার পাওয়া অন্য সাত বিশিষ্ট ব্যক্তি হলেন-কমান্ড্যান্ট প্রয়াত মানিক চৌধুরী (স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ), সাবেক ডিআইজি প্রয়াত মামুন মাহমুদ (স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ), সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়া (প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক), শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (সাহিত্য), চলচ্চিত্র অভিনেতা নায়করাজ আবদুর রাজ্জাক, কৃষিবিদ মোহাম্মদ হোসেন মণ্ডল (কৃষি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ) ও সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত (সাংবাদিকতা)।

৪ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আটজনকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। এর মধ্যে অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ স্বাধীনতা পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা।

পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেককে ১৮ ক্যারেটের ৫০ গ্রাম স্বর্ণপদক, দুই লাখ টাকা ও সম্মাননাপত্র দেওয়া হয়।

পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নিজের অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে তাঁর বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, অতীতে স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিকে পুরস্কার দিয়ে এই পুরস্কারকে অসম্মানিত করা হয়েছে। তবে তিনি মনে করেন, আজ তাঁরা যে সম্মান লাভ করলেন, সেটি তাঁদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান। পুরস্কার পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছেন বলেও জানান আনিসুজ্জামান।


অগ্নিঝরা মার্চ বিভাগের আরো খবর...
শেখ হাসিনাকে নিয়ে ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন শেখ হাসিনাকে নিয়ে ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন
শিরমাল রুটি শিরমাল রুটি
ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ও বুড়িগঙ্গা ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ও বুড়িগঙ্গা
৩০০ আসনে মহাজোটের প্রার্থী যারা ৩০০ আসনে মহাজোটের প্রার্থী যারা
বিদেশি পর্যবেক্ষক আনতে অন অ্যারাইভাল ভিসা বিদেশি পর্যবেক্ষক আনতে অন অ্যারাইভাল ভিসা
আ. লীগের যেসব হেভিওয়েট নেতা মনোনয়ন পাননি আ. লীগের যেসব হেভিওয়েট নেতা মনোনয়ন পাননি
গণফোরামে যোগ দিলেন আ’লীগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ গণফোরামে যোগ দিলেন আ’লীগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ
ঘোষণা ছাড়াই মনোনীত প্রার্থীদের চিঠি দিচ্ছে বিএনপি ঘোষণা ছাড়াই মনোনীত প্রার্থীদের চিঠি দিচ্ছে বিএনপি
আ. লীগের মনোনয়ন পেলেন যেসব তারকা আ. লীগের মনোনয়ন পেলেন যেসব তারকা
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন যারা পেলেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন যারা পেলেন

‘ধ্বংস নয়, আমরা শান্তি চাই’
(সংবাদটি ভালো লাগলে কিংবা গুরুত্ত্বপূর্ণ মনে হলে অন্যদের সাথে শেয়ার করুন।)
tweet